May 18, 2024, 3:57 am

কে হবেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তী উপাচার্য

কে হবেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তী উপাচার্য?

Spread the love

নিজস্ব প্রতিনিধি

এম আবদুস সোবহানের  মেয়াদ  শেষেরপর তিন সপ্তাহ ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটি ফাঁকা রয়েছে। এতে করে ব্যাহত হচ্ছে প্রশাসনিক ও শিক্ষা কার্যক্রম। তাই দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে একজন ‘যোগ্য উপাচার্য’ নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

গত ৬ মে ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য এম আবদুস সোবহানের শেষ কর্মদিবস। শেষ দিনে তিনি ১৩৮ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়েন পুলিশ পাহারায়। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। নিয়োগ বাতিল এবং এম আবদুস সোবহান যেন দেশত্যাগ করতে না পারে,  সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আবদুস সোবহান ও তার পরিবারের চার সদস্যের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল।

উপাচার্যের দৌড়ে রয়েছেন যারা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দৌড়ে অনেকের নাম শোনা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম প্রথমে রয়েছে। নিচে সেই তালিকা দেওয়া হলো :

অধ্যাপক রকীব আহমেদ : ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের এই অধ্যাপক এখন অবসর পরবর্তী ছুটিতে (পিআরএল) রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অবসরে যাবেন আগামী ৩০ জুন। এই অধ্যাপক সদ্য বিদায়ী উপাচার্য এম আবদুস সোবহান ঘনিষ্ঠ বলেই ক্যাম্পাসে পরিচিত। অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান প্রথম মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) উপাচার্য থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের (আইইএস) পরিচালক করেছিলেন রকীব আহমেদকে। ওই সময় আরও বেশ কয়েকটি দায়িত্বে তাকে রেখেছিলেন আবদুস সোবহান।

২০১৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হওয়ার জন্য বেশ দৌড়ঝাপ করেছিলেন অধ্যাপক রকীব আহমেদ। কিন্তু ওই সময় তিনি সেই দায়িত্ব পাননি। তখন আবদুস সোবহানকে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়। রকীব আহমেদ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক ছিলেন। উপাচার্য না হতে পেরে তিনি জার্মানিতে চলে যান। পরে দেশে আসলে সদ্য বিদায়ী উপাচার্য এম আবদুস সোবহান তাকে ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজের দায়িত্ব দেন। তিনি উপাচার্যের একনিষ্ঠ হিসেবে সেই দায়িত্ব পালন করেন।

এর আগে ওয়ান ইলেভেনের সময় যখন দেশ উত্তাল, তখন দেশ ছাড়েন অধ্যাপক রকীব আহমেদ। চলে যান পাকিস্তানে। সেখানে দি ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাহায়ালপুরের ভূগোল বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়া তিনি বিশ্বের আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন।

অভিযোগ আছে, অধ্যাপক রকীবের এক ভাই রাজশাহী কলেজে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ব্যাংকে চাকরি করা আরেক ভাইয়ের বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।

অধ্যাপক জিনাত আরা : বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের এই অধ্যাপক বিভাগটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ডিন ছিলেন। তার বাবা আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ছিলেন। জিনাত আরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। এম আবদুস সোবহানের অনিয়মের বিরুদ্ধে তাকে কথা বলতে দেখা গেছে।

অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান : ভূতত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান এর আগে (২০১৩-২০১৭) বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব ও ভূবিজ্ঞান অনুষদের ডীন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা এবং ভূতত্ত্ব ও খনি বিভাগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন প্রায় ৩৪ বছর ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর গত বছর পর্যন্ত ৫০ জন বিজ্ঞানীর তালিকা করা হয়, সেখানে তার নাম উঠে এসেছে ৪৩ নম্বরে।

অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান : প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি ১৯৯০ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে জাপানের ওকাইমা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মলিকুলার বায়োলজির ওপর পিএইচডি করেন।

অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম : বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এই অধ্যাপক রাজশাহী জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তার পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম ২০১৯ সাল থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্ডিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া ২০২০ সাল থেকে তিনি পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য রয়েছেন।

অধ্যাপক শফিকুন্নবী সামাদী : বাংলা বিভাগের এই অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রশাসক ছিলেন। সদ্য বিদায়ী উপাচার্যের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাকে আন্দোলনে সোচ্চার হতে দেখা গেছে। আওয়ামীপন্থী দলীয় শিক্ষকদের স্টিয়ারিং কমিটির নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি কনভেনিং কমিটির একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

অধ্যাপক এম. শহীদুল্লাহ : ইংরেজি বিভাগের এই অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। তিনি বিদায়ী উপাচার্য এম আবদুস সোবহানের ঘনিষ্ঠ। উপাচার্য এম আবদুস সোবহানের সময় তিনি ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাংগুয়েজেজ-এর পরিচালকের দায়িত্বে পান। এখনো সেই দায়িত্বে রয়েছেন। আবদুস সোবহানের আগের মেয়াদে তিনি ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস) এর পরিচালক ছিলেন।

এ ছাড়া উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে আরও রয়েছেন বর্তমান উপ-উপাচার্য আনন্দ কুমার সাহা, ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা বিভাগের অধ্যাপক সাইয়েদুজ্জামান মিলন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। তাই স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করার একটি বিধান রাখা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রক্রিয়ায় আর উপাচার্য নিয়োগ হয় না। এখানে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ অনুযায়ী আচার্য (মহামান্য রাষ্ট্রপতি) উপাচার্য নিয়োগ দেন। ২২ বছর ধরে চলছে এই প্রক্রিয়া। ফলে উপাচার্য হওয়ার জন্য আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বলেন, সদ্য সাবেক উপাচার্য এম আবদুস সোবহন পুলিশের পাহারায় ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। এখনো তিনি পুলিশের পাহারায় রয়েছেন। একজন অধ্যাপকের জন্য এর চেয়ে আর ‘নিষ্ঠুর নিয়তি’ কী হতে পারে। তিনি যেন দেশত্যাগ করতে না পারেন, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে ইউজিসি। এমন ‘অপমানজনক’ অবস্থানে থেকেও সাবেক উপাচার্য গলাফুলিয়ে কথা বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিষদ্গার করেন।

প্রগতিশীল কয়েকজন শিক্ষক জানান, এবার উপাচার্য হিসেবে যিনি নিয়োগ পাবেন, তার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। যদি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নষ্ট হয়ে যাওয়া সম্মান’ কিছুটা হলেও উত্তরণ করতে চান, তাহলে তাকে সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতেই হবে। না হলে এম আবদুস সোবহানের চেয়েও খারাপ অবস্থা নিয়ে তাকে চার বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নিতে হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন একজন উপাচার্য প্রয়োজন, যিনি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারবেন। স্থানীয় রাজনীতি থেকে ক্যাম্পাসকে বাইরে রাখতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা রক্ষায় যিনি সকল চাপ উপেক্ষা করতে পারবেন।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্তত চার-পাঁচ বছর পর অবসরে যাবেন-এমন কাউকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। কেননা অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানের চাকরি মেয়াদ থাকলে তিনি শেষ কর্মদিবসে গণহারে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে যেতে পারতেন না। শুধু তাই নয়, তিনি একের পর এক অনিয়ম করেছেন শুধু পিছুটান নেই বলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ফিরে আসতে হবে না বলেই। তাই নতুন উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই ভাবতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই, এমন কাউকে উপাচার্য করা মোটেও যুক্তিযুক্ত হবে না। এটা না করলে আগামীতে আবার অনিয়মের দ্বার খুলে দিতে পারেন সেই দায়বদ্ধহীন উপাচার্য।

প্রসঙ্গত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালনের জন্য গত ৬ মে উপ-উপাচার্য আনন্দ কুমার সাহাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

 


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category